গাভীরখামার ব্যবস্থাপন
 
বাংলাদেশেপ্রতিবছর দুধের চাহিদা ১২.৫২ মিলিয়ন মেট্রিক টন, উৎপাদন হচ্ছে প্রতিবছর ২.২৮ মিলিয়নমেট্রিক টন, ঘাটতি প্রতিবছর ১০.২৪ মিলিয়ন মেট্রিক টনচাহিদার আলোকে আমাদের দেশেছোট-বড় প্রায় ৪৭,৭১০টি ডেইরি খামার গড়ে উঠেছেবর্তমানে শংকর জাতের গাভী পালনেরমাধ্যমে দুগ্ধ খামার স্থাপন একটি লাভজনক ব্যবসাফলে গাভী পালনে উন্নত ব্যবস্থাপনা, সঠিক প্রজনন, সুষম খাদ্য, রোগদমন ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পর্কে খামারিদের জানা প্রয়োজন
 
ভালজাতেরগাভীর বৈশিষ্ট্য- মাথা : হালকা ও ছোট আকার, কপাল প্রশস্ত, উজ্জ্বল চোখ, খাদ্যেরপ্রতি আগ্রহদৈহিক বৈশিষ্ট্য : দেহের সামনে দিক হালকা, পিছনের দিক ভারী ওসুসংগঠিত, দৈহিক আকার আকর্ষণীয়, শরীরের গঠন ঢিলাপাজর : পাজরের হাড় স্পষ্ট, হাড়েরগঠন সামঞ্জস্যপুর্ণচামড়া : চামড়া পাতলা, চামড়ার নীচে অহেতুক চর্বি জমা থাকবে না, চামড়ার রঙ উজ্জ্বল, লোম মসৃণ ও চকচকে হবেওলান : ওলান বড় সুগঠিত ও দেহের সাথেসামঞ্জস্যপূর্ণ, বাটগুলো একই আকারের হবেচারবাট সমান দূরত্বে ও সমান্তরাল হবেদুগ্ধশিরা : দুগ্ধশিরা মোটা ও স্পষ্ট, তলপেটে নাভীর পাশ দিয়ে দুগ্ধশিরাআঁকাবাঁকাভাবে বিস্তৃত থাকবে
 
খামারব্যবস্থাপনা : খামার ব্যবস্থাপনা এক প্রকার কৌশল যার মাধ্যমে খামারের সম্পদ, সুযোগও সময়ের সমন্বয় ঘটানো যায়সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার সুফল হল- ১. সম্পদের মিতব্যয়িতা ২.স্বল্প সময়ে ফললাভ ৩. স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদন ৪. শক্তি ও শ্রমের অপচয় রোধ ৫.উৎপাদনে গুণগতমান ও উৎকর্ষতা লাভ
 
সাধারণব্যবস্থাপনা: গাভী তার গুণগতমান উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকেকিন্তু গাভীরবংশানুক্রমিক গুণগতমান যতই ভাল হোক এর ব্যবস্থাপনা সমন্ধে বিশেষ যতœবান হওয়াপ্রয়োজনদৈনন্দিন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, বিজ্ঞান সম্মত বাসস্থান, সুষম খাদ্যসরবরাহ, সঠিক প্রজনন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইত্যাদি উন্নত গাভী পালনের মৌলিকবিষয়
 
বাসস্থান:পারিবারিক পর্যায়ে বা খামার পর্যায়ে গাভী পালন করতে হলে গাভীর জন্য ভাল বাসস্থানপ্রয়োজনগাভীকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরমএবং অন্যান্য নৈসর্গিক দৈব দুর্বিপাক, পোকামাকড়, চোর, বন্য-জীবজন্তু হতে রক্ষা করারজন্য যথোপযুক্ত বাসস্থান বা গোয়ালঘর প্রয়োজনআমাদের আবহাওয়ার আলোকে ঘরে প্রচুর আলোবাতাস চলাচলের জন্য ঘরটি উত্তর-দক্ষিণমুখী হওয়া বাঞ্চনীয়কোন অবস্থাতেই যেন ঘরেস্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা যেন না থাকেএতে ঘরের মেঝেটি ইট বিছানো থাকলে ভাল হয়ঘরেরদুর্গন্ধ ও মশামাছি দমনের জন্য মাঝে মাঝে জীবাণুনাশক দ্বারা ধোয়া প্রয়োজন
 
গবাদিপশুরবাসস্থান দুই ধরণের হতে পারে : ১. উন্মুক্ত বা উদাম ঘর ২. বাঁধা ও প্রচলিত ঘর
 
বাঁধা ঘরেরবৈশিষ্ট্য : এই পদ্ধতিতে গরুর গলায় দড়ি বা লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে পালন করা যায়গাভীর খাদ্য, পানি গ্রহণ এবং দুধ দোহন একই স্থানে করা যায়
 
সুবিধা :বাঁধা থাকে বিধায় গাভীর দুধ দোহন সহজ হয়, প্রতিকূল আবহাওয়ায় পশু নিরাপদ থাকে, কৃত্রিম প্রজননের জন্য বেশ সুবিধাজনক, নির্ধারিত অল্প জায়গায় পশু পালন করা যায়
 
অসুবিধা :এই পদ্ধতিতে ঘর তৈরি খরচ বেশি, পশুর সহজে ঘোরাফেরার ব্যবস্থা থাকে না, এতে পশুরব্যয়াম না হওয়াতে বিভিন্ন ধরনের রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে, একই জায়গায় দিনরাত্রিবাঁধা থাকে বলে মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে থাকে
 
বাঁধা ঘরেরনকশা : এই পদ্ধতির গো-শালায় পশু সব সময় বাঁধা অবস্থায় থাকেএজন্য গো-শালা যাতেসহজে পরিস্কার করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে ঘর তৈরি করা প্রয়োজনপ্রচলিত গো-শালাদুই ধরনের হয়-
 
একসারিবিশিষ্ট গো-শালা : অল্প সংখ্যক গবাদি পশুর জন্য একটি লম্বা সারিতে বেঁধে পালনেরজন্য এই গো-শালা তৈরি করা হয়প্রতিটি পশুকে পৃথক রাখার জন্য জিআইপাইপ দিয়েপার্টিশন দেয়া হয়, পার্টিশনের পাইপ লম্বায় ৯০ সে.মি. এবং উচ্চতায় ৪৫ সে.মি. হওয়াপ্রয়োজন, একটি গরুর দাঁড়াবার স্থান ১৬৫ সে.মি., পাশের জায়গা ১০৫ সে.মি., খাবারপাত্র ৭৫ সে.মি. এবং নালা ৩০ সে.মি. হওয়া প্রয়োজন, একই মাপে পশুর সংখ্যা অনুযায়ীজায়গা নির্ধারণ করে গো-শালা তৈরি করা হয়, গো-শালা হবে একচালা বিশিষ্ট ঘর, ঘরের ছাদপ্রায় ৩০০ সে.মি. উঁচুতে করতে হয়
 
দুই সারিবিশিষ্ট গো-শালা : অল্প জায়গায় অধিক পশুপালনের জন্য এ ধরণের গো-শালা তৈরি করা হয়, ধরনের গো-শালায় পশুকে দুভাবে রাখা যায়, মুখোমুখি পদ্ধতি ও বাহির মুখ পদ্ধতিমুখোমুখি পদ্ধতিতে দুই সারি পশু সামনাসামনি থাকেদুইসারি খাবারের পাত্রের মাঝখানে১২০ সে.মি. চওড়া রাস্তা থাকে- যা পাত্রে খাবার দেবার জন্য ব্যবহার করা হয়, একটিগরুর জন্য দাঁড়ানোর জায়গা ৫.৫ ফুট, পাশের জায়গা ৩.৫ ফুট
 
সুবিধা :একই সাথে দুইসারি পশুকে সহজে খাবার ও পানি সরবরাহ করা যায়, দুধ দোহনের জন্য অধিকতরআলো পাওয়া যায়, পশু নিজ জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, পরিচর্যাকারী সহজে চলাফেরাকরতে পারে
 
একটিগাভীকে নিম্ন তালিকা অনুসারে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে : কাঁচা ঘাস (সবুজ ঘাস) ২০-৩০কেজি, দানাদার খাদ্য মিশ্রণ: ১৮-২০% প্রোটিন সমৃদ্ধ: ১ম ৩ কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য-০৩ কেজি, পরবর্তী প্রতি কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য-০.৫ কেজি, লবণ-৫০-৬০ গ্রাম, পরিস্কার পানি-প্রয়োজন মত
 
পরিচর্যা :গাভীর সঠিক পরিচর্যা না করলে উন্নত জাতের গাভী পালন করেও গাভীকে সুস্থ সবলউৎপাদনক্ষম রাখা সম্ভব হবে নাফলে গাভী হতে কাক্সিক্ষত পরিমাণ দুধ, মাংস পাওয়াযাবে না এবং গাভী পালন অলাভজনক হবে
 
দুধ দোহন :গাভীর দুধ দৈনিক ভোরে একবার এবং বিকালে একবার নির্দিষ্ট সময়ে দোহন করতে হবেদুধদোহনের পূর্বে গাভীর উলান ও দোহনকারীর হাত পরিস্কার পানি দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে নিতেহবে
 
প্রজনন :গাভীর বংশানুক্রমিক গুণগতমান উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পিত প্রজনন ব্যবস্থাঅবলম্বন করতে হবেযে ষাড়ের মা, দাদী, নানী যত বেশি পরিমাণ দুধ দেয় তার বাচ্চার দুধউৎপাদনের ক্ষমতা ততই বেশি হয়তাই যখন গাভী গরম হবে তখন গুণগতমানসম্পন্ন ষাড়ের বীজদ্বারা নিকটস্থ কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র হতে গাভীকে প্রজনন করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন
 
খামারেররেকর্ড সংরক্ষণ : খামারের লাভক্ষতি নিরূপণ আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাবের উপর নির্ভরশীলসুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিয়য়ে মূল্যায়ন করাদরকারখামারের উৎপাদিত পণ্যের হিসাব, ক্রয়, বিক্রয়, জন্ম, মৃত্যু এবং কৃত্রিমপ্রজনন কার্যক্রমের জন্য সঠিক তথ্য রক্ষাকল্পে রেকর্ড সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যকীয়
 
উন্মুক্তবাসস্থানে নিম্নোক্ত হারে জায়গার প্রয়োজন :
 
পশুর ধরণঘরে প্রতি পশু স্থান প্রতি পশুর জন্য মুক্ত স্থান খাদ্যপাত্র
 
বাড়ন্তবাছুর ২.৫-৩ বর্গ মিটার ৫-৬ বর্গ মিটার ৩৭-৫০ সেন্টিমিটার
 
গাভী ৩-৩.৫বর্গ মিটার ৮-১০ বর্গ মিটার ৫০-৬০ সেন্টিমিটার
 
গর্ভবতীগাভী ১০-১২ বর্গ মিটার ১৮-২০ বর্গ মিটার ৬০-৭০ সেন্টিমিটার
 
কৃষিবিদসোহরাব জিসান